সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হাজতখালী এলাকার হারেজ সরদার। খুবই হতাশকণ্ঠে বলেন, আগে আমরা পুকুরের পানি খাতাম, কিন্তু এহেনে চিংড়ি চাষ হওয়ায় সেই পানি নষ্ট হইয়ে গেছে। আর আম্ফানের পরতো খাওয়ার পানিই পাচ্ছি না। পায়ে হাঁইটে অথবা নৌকোয় কইরে দু-তিন মাইল যাইয়ে এক কলস পানি আনতি হচ্ছে। তাও পানি পাওয়া যায় না। পানিরতো হাহাকার চলতিছে।
শুধুমাত্র কয়রা নয়, আম্ফান-উপদ্রুত দেশের পশ্চিম উপকূলজুড়ে এখন সুপেয় পানির তীব্র হাহাকার চলছে। এমনিতেই এসব এলাকায় বরাবরই সুপেয় পানির সংকট থাকে, ঘূর্ণিজড় আম্ফান-উত্তরকালে পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল ও ভয়াবহ হয়েছে। কেউ কেউ দু-তিন মাইল দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করছেন; কেউ কেউ এনজিও বা অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা পানি সহায়তার দিকে চেয়ে আছেন। পানিবাহিত রোগ-ব্যাধি শুরু হয়েছে। যদি সুপেয় পানি সরবরাহ করা না যায়, তাহলে এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য-সমস্যা আরেক সংকট হিসেবে দেখা দেবে।
প্রকৃতপক্ষে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের দাপটে দেশের পশ্চিম উপকূল – সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা; খুলনা জেলার কয়রা ও দাকোপ উপজেলা; বাগেরহাট জেলার মোংলা ও শরণখোলা উপজেলা এবং পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানি ও মঠবাড়িয়া উপজেলার বেড়িবাঁধগুলো নানা জায়গায় ভেঙে নোনা পানি প্রবেশ করেছে। এতে সুপেয় পানির উৎসস্থল সুপেয় পানির পুকুরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় নলকূপ ডুবে গেছে।
সরেজমিন দেখা এবং এলাকাবাসী ও দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুপেয় পানির অভাবে অনেক জায়গায় আমাশয় ও পেটের পীড়া দেখা দিয়েছে। কয়রা উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের ৫২টি গ্রামের মানুষ নিদারুণ পানির কষ্টে। এখানকার সুপেয় পানির সকল উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। কয়রা সদর ইউনিয়নের ইমতিয়াজউদ্দিন বলেন, ২০ মে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তোড়ে বাঁধ ভেঙে যায়। ফলে মিঠা পানির পুকুর ও জলাশয়গুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চারদিক পানি থৈ থৈ করলেও সুপেয় পানি নেই কোথাও। চার দশকের বেশি সময় ধরে চিংড়ি চাষের ফলে এলাকাটি আগে থেকেই নোনায় পুড়ে আছে।
অনেক জায়গায় এনজিওদের পক্ষ হতে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের দুর্গাবাটি গ্রামে কখনও এনজিওরাও পানি নিয়ে যায়নি। এলাকার যুবক, স্কুলশিক্ষক দেবপ্রসাদ বিসমিলের উদ্যোগে ফুলতলার রহমানিয়া এলিমেন্টারি স্কুলের সহায়তায় সেখানকার মানুষদের পানি দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন প্রতিপরিবারপিছু এক কলস। তারা প্রতিলিটার পানি ৫০ পয়সা দরে কিনে এক হাজার লিটারের ট্যাংকিতে ভরে পানি নিয়ে সেই গ্রামে যায়; আর পানি বিলি করেন। তিনি জানান, পানির যা কষ্ট, তাতে চলতি জুন মাস এভাবে দিলেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে কি-না সন্দেহ। তারা অন্তত এই এক মাস এভাবে পানি সরবরাহ করতে চান।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও ইন্দুরকানি উপজেলার ১২টি গ্রামে জলোচ্ছ্বাসের পানি প্রবেশ করে। এরপর সেখানে জোয়ারের নোনা পানি প্রবেশ করে। খাবার পানির অন্যতম প্রধান উৎস পুকুরগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুদীপ বালা বলেন, আম্ফানের কারণে মাছ, পশু ও পাখি মরে পানিতে পড়ে থাকার কারণে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আক্রান্ত ৪টি ইউনিয়নে ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখান থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হচ্ছে। কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা জানান, প্রশাসন থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, দেশের পশ্চিম উপকূল ঈষৎ নোনাভূমি অঞ্চল। একে ব্রাকিশ ওয়াটার জোন বলা হয়। আগে থেকেই এখানে নোনা ছিল। দীর্ঘদিন ধরে নোনা পানির চিংড়ি চাষের ফলে এখানকার মাটিতে নোনা আরো বেড়েছে। যথেচ্ছ বাঁধ কাটায় তা দুর্বল হয়েছে। ফলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভাঙে, মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। সাধারণভাবেই এখানে খাবার পানির সমস্যা, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগে আরো বাড়ে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসেবে স্বাভাবিক অবস্থায় খুলনা জেলার ২২ শতাংশ, সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ এবং বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। এই সংকট শহর এলাকা থেকে যত দক্ষিণে ততোই বেশি প্রকট ছিল। ওই হিসেবেই কয়রা উপজেলার ৪৫ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পেত না, তারা পুকুরের পানি পান করত। যা এখন ভয়াবহ সংকটে রূপ নিয়েছে।
উত্তর বেদকাশি হাজতখালী অনুরাধা রানী বলেন, খাবার পানির বড্ড কষ্ট। খাবার না পেলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু সময়মতো পানি না পেলে খুব কষ্ট হয়। এ কারণে কপোতাক্ষ নদ পার হয়ে ওপার থেকে কলস ভরে পানি আনতে হয়। নদ পারাপার করে পানি আনা খুবই কষ্টের।
খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও বেড়িবাঁধ ভেঙে জলোচ্ছ্বাসের কারণে শুধুমাত্র কয়রায় তাদের ৯০০ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে কয়রা সদরে দুটি ভ্রাম্যমাণ প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এ প্লান্টের মাধ্যমে পানিকে সুপেয় করা হচ্ছে। প্রতিঘণ্টায় এ থেকে ২ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। কয়রার পাশাপাশি পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায়ও একটি করে ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করেছে।