দিন যতই যাচ্ছে রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য কমে আসছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-আইসিইউ’র সংখ্যা। অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তুলনায় শূন্য বেডের সংখ্যা ছিল বেশি। গত ২৭ নভেম্বর ঢাকায় করোনা রোগীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড ফাঁকা ছিল ৯০টি। ১৬ দিনের ব্যবধানে সোমবার (১৪ ডিসেম্বর) ফাঁকা আইসিইউ আছে মাত্র ৫১টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরুর পর থেকে হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আইসিইউতে খালি বেডের সংখ্যা কমছে।
সোমবারের হিসাব অনুযায়ী, করোনা রোগীদের জন্য সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ডেডিকেটেড কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ১৬ বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০ বেড, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬ বেড, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০ বেড এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ বেডের প্রতিটিতে রোগী ছিলেন। অর্থাৎ এসব হাসপাতালের আইসিইউতে কোনও বেড খালি ছিল না। এছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪টি বেডের মধ্যে ২০টিতে রোগী ছিল। ফাঁকা ছিল চারটি বেড।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১১৩টি। এরমধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ১০২ জন, আর ফাঁকা রয়েছে ১১টি বেড। অপরদিকে তালিকাভুক্ত বেসরকারি হাসপাতালে মোট বেড রয়েছে ১৭৫টি। রোগী ভর্তি আছেন ১৩৫ জন, ফাঁকা বেড রয়েছে ৪০টি। অর্থাৎ রাজধানীতে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সোমবার পর্যন্ত আইসিইউতে করোনা রোগীদের জন্য শূন্য বেড ছিল মাত্র ৫১টি।
জানা গেছে, সারা দেশে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড আছে ৫৭০টি। সোমবার পর্যন্ত রোগী ভর্তি আছেন ৩৩৪ জন, আর বেড শূন্য রয়েছে ২৩৬টি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনা রোগীদের শতকরা ৮০ শতাংশের মধ্যে মৃদু লক্ষণ দেখা দেয়। তাদের হাসপাতালে যেতে হয় না। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে ১৫ শতাংশের উপসর্গ তীব্র হয়, যাদেরকে হাসপাতালে যেতে হয়। বাকি ৫ শতাংশের অবস্থা থাকে বেশি জটিল, তাদের জন্য আইসিইউ বেডের পাশাপাশি দরকার হয় ভেন্টিলেটর।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাঝামাঝি সময়ে জুন-জুলাইয়ের দিকে আইসিইউ না পেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও গণমাধ্যমে এসেছে। আগস্ট থেকে সংক্রমণের হার কমার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা এবং সাধারণ শয্যা ফাঁকা হতে শুরু করে। শয্যা ফাঁকা থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের সংখ্যাও কমিয়ে আনে।
তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকার হাসপাতালগুলোর আইসিইউতে রোগীর সংখ্যা ফের বাড়তে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ঢাকায় সারা দেশ থেকে আসা রোগীদের চাপ বেড়েছে। এ কারণে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফাঁকা বেড একেবারেই থাকছে না। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে খরচ অনেক বেশি হওয়ায় রোগীরা সরকারি হাসপাতালে বেশি আসছেন।
গত ২ জুন দেশের প্রত্যেকটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জানা গেছে, সহসাই এই নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
কর্মপরিকল্পনা, চিকিৎসক সংকট, সরঞ্জামাদি ব্যবস্থাসহ আইসিইউ বেড স্থাপন সহসাই হচ্ছে না বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে কর্মরত ডা. আমির হোসেন।
তিনি জানান, সরকার ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়নে সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তড়িঘড়ি করে করোনা মোকাবিলায় এ কর্মপন্থা বাস্থবায়ন করা দরকার বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, আইসিইউ বেড তৈরি করতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্টের কাজই শুরু করতে পারেনি ঝালকাঠি স্বাস্থ্য বিভাগ। এছাড়া, আইসিইউ চালানোর মতো বিশেষজ্ঞেরও সংকট রয়েছে সেখানে।
মাগুরা জেলার সিভিল সার্জন প্রদীপ কুমার সাহা জানিয়েছেন, মাগুরায় এখনও কোনও আইসিসিইউ ওয়ার্ড নেই। তিনি বলেন, ‘এ জেলায় এখনও করোনা সংক্রমণ তীব্র না হওয়ায় খুব একটা সমস্যার মুখোমুখি আমরা হইনি।’ তবে এটি শেষ কথা নয়, বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে জামালপুরে এখনও কোনও আইসিইউ বেড স্থাপিত হয়নি।
নোয়াখালীতে শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে সাময়িকভাবে স্থাপিত কোভিড-১৯ হাসপাতালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দুইটি ভেন্টিলেটর মেশিন দেন। সেখানে আইসিইউ বেড রয়েছে দুইটি। ‘কিন্তু জনবলের অভাবে সেগুলো চালু করা যায়নি’, বলেন হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. নিরুপম দাশ। তিনি বলেন, ‘আইসিইউর প্রয়োজন ছিল এমন অন্তত পাঁচ জন রোগীকে আমরা রেফার করেছিলাম ঢাকায়, কিন্তু তারা পথেই মারা গেছেন।’
‘এ হাসপাতালে আইসিইউ থাকলে অন্তত তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যেতো’, বলেন ডা. নিরুপম দাশ।
কুড়িগ্রাম ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালসহ এ জেলায় সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে কোনও হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র নেই। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য যেতে হয় ৫৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান জানান, জেলার কোনও হাসপাতালেই আইসিইউ সুবিধা নেই। জেনারেল হাসপাতালে এখনও সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেম চালু করা সম্ভব হয়নি।
আইসিইউতে রোগী কেন বাড়ছে জানতে চাইলে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস আগের চেয়ে আরও বেশি তীব্রতা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আবার ঢাকার বাইরে থেকেও জটিল রোগীদের এখানে রেফার করা হচ্ছে। কারণ, ঢাকার বাইরে আইসিইউ ব্যবস্থাপনা তত উন্নত না।’
ঢাকার সরকারি হাসপাতালের অধিকাংশ আইসিইউতে রোগী ভর্তি থাকে জানিয়ে ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, ‘আবার বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে যে খরচ, সবার পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না।’
কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলা পর্যায়ের প্রতিটি হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশনার পরও যদি এটা না হয়, তাহলে বোঝাই যাচ্ছে— আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কী অবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘আমি খুবই হতাশ, গত কয়েক সপ্তাহে প্রতিদিন যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতিটি জায়গায় যদি আইসিইউ সুবিধা পেতো তাহলে তাদের ঢাকায় আসতে হতো না। রাস্তায়ই অনেকে মারা যাচ্ছেন। আবার অনেকেই ঢাকায় এসেও আইসিইউ পাচ্ছেন না।’ তাহলে এই মানুষগুলোর মৃত্যুর জন্য কে দায়ী, প্রশ্ন করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কার কাছে তাদের মৃত্যুর জন্য জবাব চাইবো।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, ‘যেসব জায়গায় আইসিইউ বেডের ফ্যাসিলিটিস ডেভেলপ করা যাবে, সেখানে আমরা আইসিইউ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে কেবল আইসিইউ বেড হলেই হবে না, এর জন্য প্রশিক্ষিত জনবল দরকার।’ তিনি বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে সবই হবে। আমাদের পরিকল্পনায় এটা রয়েছে।’
এজন্যই কি ঢাকায় দিন দিন আইসিইউ বেডের সংখ্যা কমছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মে বি।’
যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন তাদের ৮০ শতাংশই ঢাকায়। তারা কি ঢাকার বাসিন্দা, নাকি বাইরে থেকে আসা রোগী? এমন প্রশ্নে ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, ‘বাইরে থেকেও আসতে পারে। আমরা তো ঢাকায় আসার পথ বন্ধ করে দেইনি।’